বিষয়টা ক্ষোভের নয়, লোভের


বিষয়টা নতুন নয়, একেবারেই সাধারণ চিত্র। সবকিছু ঠিক থাকলে সামনের বছরগুলোতে এর থেকেও বাজে ঘটনার শিকার হওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত। বিষয়টা ক্ষোভের নয়, লোভের। আগুনের সঙ্গে লোভের সম্পর্ক কী? এককথায় বলতে গেলে শুধু লোভের কারণেই আগুনের সৃষ্টি। শুধু লোভ সামলাতে না পারার কারণে বিলিয়ে দিতে হচ্ছে হাজারও প্রাণ এবং এই সংখ্যা আরো বাড়তেই থাকবে। এই আগুন বাংলাদেশে থামার কথা না, যদি থেমে যায় সেটা হবে বিস্ময়ের। চাইলেই আগুনের জন্য এক-দুজন বা এক-দুটি প্রতিষ্ঠানের ওপর দায় চাপিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু যদি আসলেই আগুনের রহস্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা খুঁজতে শুরু করি, তবে বেরিয়ে আসবে জানা-অজানা অনেক কিছুই।
২০১০ সালে নিমতলীতে অগ্নি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ১২৪ জন। তদন্ত কমিটির স্পষ্ট প্রতিবেদন বলছে, রাসায়নিক কারখানার ফলে এই আগুনের উৎপত্তি। সেবার খুব তোড়জোড় করেই রাসায়নিক কারখানা সরানোর কথা বললেও আজও পর্যন্ত সরেনি সেই কারখানা। বিষয়টা ক্ষোভের নয়, লোভের। ১২৪ জন প্রাণ হারালে কারখানা মালিকদের কী আসে-যায়? কারখানা করার অনুমতি যারা দেন, তাদের কী আসে-যায়? কোনো কিছুই না। রাসায়নিক কারখানা থেকে আগুন লেগে যত মানুষ নিহত হয়েছে; সে তুলনায় অনেক বেশি আয় হয়েছে সেই কারখানা থেকে। বিষয়টা পরিষ্কার, নয়তো এত দিনে কারখানার হদিস পাওয়া যেত না। সুতরাং ক্ষোভ করে লাভ নেই, টাকা একটি বড় ব্যাপার এখানে। এমনকি মানুষের জীবনের থেকেও।
২০১২ সাল, তাজরীন ফ্যাশন। ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় নিশ্চিন্তভাবে তাজরীন ফ্যাশনে চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েন ১১৭ জন পোশাকশ্রমিক। সরাসরি অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান ১০১ জন আর আগুন থেকে রেহাই পেতে ভবন থেকে লাফ দিয়ে মারা যান আরো ১০ জন। বলা হয়েছিল, শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত। যদিও প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছিলেন, এটি পূর্বপরিকল্পিত, তাই ধরা যাক এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। যতদূর পড়েছি, বুঝেছি, জেনেছি, শুনেছি, বিল্ডিং কোডের হিসাব অনুযায়ী সাততলা ভবনের থেকে বড় ভবন হলেই সেই ভবনে অবশ্যই ফায়ার ব্রিগেড সিস্টেম রাখা বাধ্যতামূলক। তাজরীন ফ্যাশন একটি গার্মেন্টস কারখানা। এসব কারখানায় তো ফায়ার ব্রিগেড সিস্টেম রাখার প্রশ্নই উঠে নাÑ বিষয়টা কি এমন? না, বিষয়টা এমন নয়, বিষয়টা হলো ওরা শ্রমিক, ওদের মূল্য কত? বিষয়টা ক্ষোভের নয়, লোভের। ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশে আগুনে পুড়ে ৬০০ জন শ্রমিক মারা গেছেন। তাদের জীবনের নিরাপত্তার কোনো দরকার নেই, তবে তাজরীন ফ্যাশনসের মালিকদের জীবনের নিরাপত্তার প্রচুর দাম, নিলামে ওঠালে চড়া দামে বিক্রি হবে। এ শ্রমিকদের মাসিক বেতন ৬০০০ টাকার মতো, ওদের জীবনের মূল্য আর কত হবে? জীবনটাই তো মূল্যহীন, তাদের আবার ফায়ার ব্রিগেড সিস্টেম! আর ইমার্জেন্সি এক্সিট দিয়ে কী লাভ! ১০ ঘণ্টা ডিউটি করতে করতে শহীদ হয়ে যাবে, কাজে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করা যাবে না। ভবনে আগুন লাগলে লাগবে, কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এজন্য হয়তো ইমার্জেন্সি এক্সিটের কোনো ব্যবস্থাই রাখেন না ভবন মালিকরা।
ফিরে আসি চকবাজারে, সম্ভবত ৮০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এই অগ্নিকান্ডে। ঘুরে ফিরে আসে আবারও রাসায়নিক কারখানা। বিষয়টা ক্ষোভের নয়, লোভের। বাড়ি মালিকের লোভ চড়া মূল্যে বাসা ভাড়া আর কারখানা মালিকের লোভ কম খরচে রাসায়নিক কারখানা। এর সঙ্গে যদি আবার যুক্ত হয় গ্যাস সিলিন্ডার, তা হলে তো একটা অতি চমৎকার কাহিনি হয়ে যায়। হলিউড-বলিউড মুভির স্ট্যান্টম্যানগুলো বাংলাদেশ থেকে কম মূল্যে নিয়ে নিতে পারে চাইলে। কারণ এখানকার মানুষ নিজেরাও বুঝতে পারছে না কতটা ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে তারা। কোনো এক দিন রাস্তায় স্বচক্ষে একটি ঘটনার সাক্ষী হয়েছিলাম। পিকআপ ভ্যানভর্তি গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে যাওয়া হচ্ছে রাস্তায় করে। বাংলাদেশের বাস, ট্রাক চালকদের হাতে ড্রাইভিং হুইলটা ধরিয়ে দিলেই তাদের রাজ্যির ঘুম এসে হাজির হয়। পিকআপ ভ্যানচালকেরও একই অবস্থা হয়েছিল। তার হয়তো খুব বেশি ঘুম পেয়েছিল কিংবা অতিরিক্ত প্রাকৃতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি যত বাজেভাবে গাড়িটি চালানো যায় চালাচ্ছিলেন এবং যা ধারণা করা হয়েছিল ঠিক সেভাবেই স্পিড ব্রেকারের ওপরে উঠতে গিয়ে গাড়ি থেকে দুটি সিলিন্ডার ফেলে দিলেন। বাংলাদেশের গ্যাস সিলিন্ডার কোম্পানিগুলো সিলিন্ডারের সেফটির জন্য কোনো প্রকার টাকা খরচ করতে রাজি নন, তাই খালি সিলিন্ডার থেকে গ্যাস বের হতে লাগল। সে যাত্রায় ভাগ্যের অতিমাত্রার সুফলতায় বেচে গিয়েছিল অনেকগুলো প্রাণ কোনো প্রকার ক্ষতি ছাড়াই। কিন্তু কোনো শিক্ষা নেওয়া হয়নি, সামান্যতম সেফটির কথা চিন্তা করা হয়নি। কারণ ব্যাপারটা ক্ষোভের নয়, লোভের।
জনবসতিতে রাসায়নিক গোডাউন, সমস্যাটা মূলত কার! সাধারণ মানুষের, বাড়িওয়ালার নাকি রাসায়নিক কারখানা মালিকের? সমস্যাটা সবার। একজন বাড়িওয়ালা মূর্খ হতে পারেন, সে না জেনে-বুঝে বাসা ভাড়া দিতে পারেন। কিন্তু যার কারখানা তিনি! শুধু কিছু টাকা বাঁচানোর লোভে এতগুলো প্রাণ শেষ হয়ে গেল নিমিষেই। এটা দুর্ঘটনা! না, কখনোই নয়, এটা হত্যাকান্ড। এর জন্য দায়ী সবাই।
বনানীতে আগুন লাগল, ওপর থেকে মানুষ লাফিয়ে পড়ছে। আমার সোনার বাংলার সোনার মানুষগুলো নিচে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, আমার সোনার দেশের সোনার মানুষদের জন্য এ যেন এক জীবন্ত চলচ্চিত্র। বিনা পয়সায় এমন চলচ্চিত্র উপভোগ করাটা অন্য ধরনের মজা। ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে আছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, আমার সোনার মানুষরা কোনোভাবেই তাদের হাতের মোবাইল ফোনের ভিডিও করা বন্ধ করবেন না। কারণ এসব মানুষকে বাঁচানোর থেকে জরুরি হলো সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েকটা লাইক-কমেন্ট। এই মানুষিকতার মানুষদের কী আসে-যায় নিরাপত্তায়!
বাংলাদেশের মানুষ কোনো অগ্নি দুর্ঘটনা হলেই প্রথমত ফায়ার সার্ভিসের ওপর দোষারোপ করেন। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন, ফায়ার সার্ভিসের কাছে ২২ তলা পর্যন্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র রয়েছে পর্যাপ্ত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই ২২ তলা পর্যন্ত উঠার জন্য ক্রেন উঠাতে হয়। এই ক্রেন রাখার জায়গা কোথায় এই ঢাকা শহরে? রাজউক অনুমোদিত ভবন কোডগুলো মানছে না কোনো ভবন মালিকরা। রাজউকও যেন কীভাবে এসব ভবনকে অনুমোদন দিয়ে দেয়। বছরের পর বছর যায়, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না এ ভবনের বিরুদ্ধে। বিষয়টা ক্ষোভের নয়, লোভের। ঢাকার ৪৩৩টি হাসপাতালের মধ্যে ৪২২টিই ঝুঁকিপূর্ণ। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আগুন লাগার পর এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে ফায়ার সার্ভিস। বিষয়টা ক্ষোভের নয়, লোভের। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এতটাই অর্থ সংকটে ভুগছেন যে, তিনি তার হাসপাতালে ফায়ার ব্রিগেড সিস্টেম কিংবা ইমার্জেন্সি এক্সিট রাখতে পারেননি। একই অবস্থা ২২ তলা ভবনের মালিকদের ক্ষেত্রেও। ঢাকার বাড়িগুলোর মধ্যের দূরত্ব দেখলে মহাকাশবিজ্ঞানীরা ব্ল্যাকহোলের থিওরি খোঁজা শুরু করবেন এখানে। রাজউকের বিল্ডিং কোড অনুযায়ী একটি বাড়ির সামনে থেকে যতটুকু দূরত্ব থাকার কথা, তা মানা হচ্ছে না একটি বাড়ির ক্ষেত্রেও বরং রাস্তার মধ্যেই বাড়ি করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। ঢাকা শহরের বাড়িগুলোর সামনে, পেছনে বা পাশে যে পরিমাণ এসির কম্প্রেসার থাকে, তা দেখে বাহিরের পর্যটকরা আঁতকে উঠবে অচিরেই। বিশ্বের কোনো দেশে এত পরিমাণ এসির কম্প্রেসার এভাবে দেখা যায় কি না, আমার জানা নেই। সেখানে ফায়ার সার্ভিসকে দোষারোপ করাটা খুবই হাস্যকর। ফায়ার সার্ভিস সময়মতো পৌঁছাতে পারে না বলে অনেকের অভিযোগ। ফায়ার সার্ভিস অ্যালামের ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে দুর্ঘটনার উদ্দেশে রওনা দেয়। এর পরও সময়মতো পৌঁছাতে পারে না। কারণ ঢাকা শহরের অসম্ভব রোমাঞ্চকর ট্রাফিক জ্যাম। তাই ফায়ার সার্ভিস সময়মতো পৌঁছাতে পারে না দুর্ঘটনাস্থলে, আর পৌঁছাতে পারলেও সোনার দেশের সোনার মানুষদের ভিড়ে ভবনের নিচে যেতে হলে চীনের গ্রেটওয়াল পাড়ি দিতে হয়। রাজউক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না এসব ভবনের বিরুদ্ধে। তাদের কোনো পদক্ষেপ নিতে হয় না, কারণ ভবন মালিকরাই সম্ভবত রাজউক সম্পর্কে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিষয়টা ক্ষোভের! কখনোই না, বিষয়টা লোভের। যদি লোভ না হয়, তবে ধরে নিতে হচ্ছে ভবন মালিকরা অশিক্ষিত। তারা জানেন না, একটি ভবনে নিরাপত্তার জন্য কী পরিমাণ ব্যবস্থা নিতে হয়। পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, আমরাও যাচ্ছি এগিয়ে। দেশ ডিজিটাল হচ্ছে, হবে। তবে মানসিকতাকে ডিজিটাল করার ক্ষমতা কারো কাছে নেই। এমন নিম্ন মানসিকতার মানুষদের নিরাপত্তার কথা শোনানোও হাস্যকর।

দৈনিক প্রতিদিনের সংবাদ
এপ্রিল ৩, ২০১৯

No comments:

Post a Comment